বাগেরহাট: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট’সহ ১০ জেলার উপজেলায় চলছে চিংড়ি ঘেরে রেণু পোনা ছাড়ার মৌসুম। ভরা এ মৌসুমে ঘের তৈরি করেও চাষিরা ঘেরে পোনা ছাড়তে পারছে না। মরণঘাতি করোনার প্রভাবে বর্তমানে হ্যাচারীর পোনা উৎপাদন ব্যাহত।
অপরদিকে, প্রাকৃতিক উৎস্য থেকে আহরণ নিষিদ্ধ ও পরিবহন বন্ধ থাকায় চাহিদার তুলনায় সামান্য পোনা পাচ্ছে চাষিরা। ফলে রেণু পোনা সংকটে এ অঞ্চলের চিংড়ি চাষিরা দিশেহারা পড়েছেন। তাই এ উপজেলার চিংড়ি শিল্প এখন ধংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মার্চ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত মাছের রেণু উৎপাদনের ভরা মৌসুম। দেশের মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ রেণু যশোরে উৎপাদিত হয়। চাঁচড়া মৎস্যপল্লির ৩৪ হ্যাচারিতে গত বছর প্রায় দুই লাখ ৬০ হাজার কেজি রেণু উৎপন্ন হয়েছে।
চিংড়িচাষি ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাগেরহাট জেলায় ২৫০ কোটি বাগদা ও ২ কোটি গলদা চিংড়ির রেণুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এ বছর বাগদা চিংড়ির হ্যাচারিতে উৎপাদন সীমিত হওয়ায় সব চাষি তার চাহিদা অনুযায়ী মাছ ছাড়তে পারবেন না। অন্যদিকে বাগেরহাটে থাকা ১৪টি গলদা চিংড়ি হ্যাচারির সবগুলোতেই উৎপাদন বন্ধ থাকায়, প্রাকৃতিক উৎসের ওপর নির্ভর করতে হবে গলদাচাষিদের। যার ফলে গলদা চিংড়িচাষিরাও পোনা সংকটে ভুগছেন।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বাগেরহাট জেলায় ৬৬ হাজার ৭১৩ হেক্টর জমিতে ৭৮ হাজার ৬৮৫টি বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। এসব ঘেরে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬ হাজার ৫৭৫ মেট্রিক টন বাগদা ও ১৫ হাজার ৪১৩ মেট্রিক টন গলদা উৎপাদন হয়েছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে সিংহভাগ উৎপাদন না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার ফলে জেলার হাজার হাজার কোটি টাকা আয় কমে যাবে।
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে জিউধরা ইউনিয়নের চিংড়ি চাষি বলেন, আমার ১২শ’ বিঘা জমির ৩টি ঘেরে গেল বছর প্রায় ৯০ লাখ বাগদার পোনা ছেড়েছিলাম। এ বছর মাত্র ১৫ লাখ পোনা ছাড়া হয়েছে। এবার পোনা সংকটের কারণে গত বছরের তুলনায় হাজার প্রতি ৬শ’ টাকা বেশি দিয়ে পোনা কিনতে হচ্ছে। যার ফলে চাহিদা অনুযায়ী পোনা ছাড়া সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া রপ্তানি বন্ধ থাকায় স্থানীয় বাজারে কম মূল্যে বাগদা চিংড়ি বিক্রি করতে হচ্ছে।
বাগেরহাট জেলা চিংড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম সুমন বলেন, গেল দুই-তিন বছর বৈরি আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে জেলায় মোট চিংড়ির উৎপাদন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমেছে। বর্তমানে কোভিড-১৯ মড়ার উপর খাড়ার ঘার মতো দেখা দিয়েছে চাষিদের কাছে। এর ফলে চাষিরা ঘেরে থাকা বিক্রয় যোগ্য মাছ উপযুক্ত দামে বিক্রি করতে পারছে না। আবার পোনার অভাবে নতুন মৌসুমে মাছও চাড়তে পারছেন না।
বাগেরহাট জেলায় প্রায় আড়াই থেকে তিনশ কোটি বাগদার পোনা ও দেড় থেকে দুই কোটি গলদা চিংড়ি পোনার চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এবছর নানা কারণে তিন ভাগের একভাগ পোনাও পাওয়া যাচ্ছে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন। যতদিন পর্যন্ত হ্যাচারি গুলো পর্যাপ্ত পরিমাণ গলদা ও বাগদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন করতে না পারবে, ততদিন পর্যন্ত প্রাকৃতিক উৎস্য থেকে পোনা আহরণের অনুমতি দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান মৎস্যচাষীদের এই নেতা।
রামপাল উপজেলার ফয়লাহাট চিংড়ি পোনা মৎস্য আড়তদার সমিতির সভাপতি কাজী রাশেদুল ইসলাম ডালিম বলেন, দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের সব থেকে বড় পোনা বিক্রির মোকাম ফয়লাহাট। ঘেরে চিংড়ির পোনা ছাড়ার মৌসুমে প্রতি দিন এখানে কোটি কোটি টাকার পোনা বিক্রি হয়। কিন্তু এবছর পোনার সরবরাহ কম থাকায় বাজার এক ধরনের জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে। এভাবে চলতে থাকলে বাজারের দুই শতাধিক ব্যবসায়ী ও এই অঞ্চলের চাষিরা বিপাকে পরবেন বলে দাবি করেন তিনি।
বাগেরহাটের চিংড়ি গবেষনা কেন্দ্র, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এইচ এম রাকিবুল ইসলাম বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে শুধু চিংড়ি সেক্টর নয় সকল সেক্টরেই একটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে আমরা আশা করছি করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের মৎস্য সেক্টর একটি বড় সম্ভাবনার খাতে পরিণত হবে।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. খালেদ কনক বলেন, খাল খননের ফলে ঘেরে পানি নেই। বিক্রয়যোগ্য মাছের দাম নেই। বাজারে পোনা সংকট। বাগেরহাটে প্রায় দেড় কোটির মত গলদা পোনার চাহিদা রয়েছে। এ বছর ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ পোনা বাজারে পাওয়া যাবে। কোনোভাবেই পোনার চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। তবে মহামারি থেকে দেশ পরিত্রাণ পেলে চাষিদের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আশা
মোরেলগঞ্জ উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা প্রণব কুমার বিশ্বাস মুঠোফোনে জানান, করোনার কারণে মাছের খাত ক্ষতির মুখে পড়েছে। কিছু হ্যাচারী গলদা রেণু পোনা উৎপাদন করলেও তা পরিবহনের জন্য সমস্যা হচ্ছে। তিনি যে কোন সমস্যায় তার +৮৮০১৭১২২৭০৫৪৯ নং মোবাইল ফোনে চাষিদের যোগাযোগ করার অনুরোধ করেছেন।